বইয়ের নাম: দুর্গেশনন্দিনী
লেখকের নাম: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ কাল: ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ
দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাস – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের প্রথম নক্ষত্র, যিনি বাংলা উপন্যাসের সূচনা করেন। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের ব্রিটিশ ভারতীয় শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম । ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা গদ্যের প্রচলন শুরু হলেও উপন্যাস শিল্পের সার্থক যাত্রা তার হাত ধরেই ঘটে। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত “দুর্গেশনন্দিনী” উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে পরপর আরোও কিছু সার্থক উপন্যাস রচনা করে তিনা এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। যার ফলশ্রুতিতে তাকে বাংলা উপন্যাসের জনক উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে লেখকের বয়স যখন ২৬ বছর তখন তিনি এই উপন্যাসের রচনা শুরু করেন এবং ১৯৬৩ সালে তা সম্পন্ন করেন, তখন তিনি খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসের পথপ্রদর্শন ঘটে।
বিষয়বস্তু
দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের পটভূমি ও কাহিনি
“দুর্গেশনন্দিনী” মূলত ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস হলেও এটি পুরোপুরি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। ষোড়শ শতকের শেষার্ধে উড়িষ্যার আধিপত্য নিয়ে মোগল ও পাঠানদের দ্বন্দ্বকে উপজীব্য করে কাহিনির বিস্তার ঘটেছে।
কাহিনি আবর্তিত হয় মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎসিংহের চারপাশে, যিনি মাত্র পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে পাঠানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। একসময় ঝড়ের কবলে পড়ে তিনি শৈলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে আশ্রয় নেন, যেখানে তার সাক্ষাৎ ঘটে মান্দারণ দুর্গাধিপতি জয়ধর সিংহের পুত্র বীরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী বিমলা ও কন্যা দুর্গেশনন্দিনী (তিলোত্তমা)-এর সঙ্গে। যদিও তারা পরস্পরের পরিচয় গোপন রাখেন, তবে জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার মধ্যে প্রেমের সূচনা ঘটে।
কপালকুন্ডলা উপন্যাসের সমালোচনাএরপর পাঠান সেনাপতি ওসমান খাঁ মান্দারণ দুর্গ দখল করে বীরেন্দ্র সিংহ, তার স্ত্রী বিমলা ও কন্যা তিলোত্তমাকে বন্দী করে। বীরেন্দ্র সিংহকে প্রহসনের বিচারের নামে হত্যা করা হয় এবং বিমলা স্বামীর হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কতলু খাঁকে হত্যা করেন। অন্যদিকে, পাঠান নবাবজাদী আয়েশা কুমার জগৎসিংহের প্রেমে পড়ে। আয়েশার প্রেমিক ওসমান এ সম্পর্কে জানতে পেরে প্রতিশোধের নেশায় জগৎসিংহের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত মান্দারণ দুর্গ পুনরুদ্ধার হয়, বিমলা রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার শুভ পরিণয় ঘটে।
শৈলী ও রচনাশৈলী
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাশৈলী অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সুললিত। তার ভাষা ও বর্ণনারীতিতে কাব্যময়তা রয়েছে, যা উপন্যাসটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। যুদ্ধের বর্ণনায় বাস্তবতার ছোঁয়া থাকলেও, প্রেমের উপাখ্যানও সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে, আয়েশার প্রেমাবেগ, জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার সম্পর্কের রসায়ন, বিমলার প্রতিশোধপরায়ণতা এবং বীরেন্দ্র সিংহের ট্র্যাজিক পরিণতি উপন্যাসের আবেগঘন দিকগুলিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ
১. কুমার জগৎসিংহ: একজন সাহসী, বীর ও প্রেমিক চরিত্র। তার চরিত্রে বীরত্ব ও রোমান্টিকতার এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়।
২. দুর্গেশনন্দিনী (তিলোত্তমা): নারী চরিত্র হলেও তাকে কেবল প্রেমিকা নয়, দৃঢ়চেতা এবং সাহসী হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে।
৩. আয়েশা: পাঠান নবাবজাদী আয়েশার চরিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার প্রেম, বিরহ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে উপন্যাসে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
৪. বিমলা: একজন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা, যার চরিত্রে প্রতিশোধপরায়ণতা ও আত্মমর্যাদার প্রতিফলন ঘটেছে।
৫. ওসমান ও কতলু খাঁ: তাদের চরিত্রে নিষ্ঠুরতা ও প্রতিশোধস্পৃহা লক্ষ্য করা যায়, যা উপন্যাসে সংঘাতের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে।
উপন্যাসের গুরুত্ব ও প্রভাব
দুর্গেশনন্দিনী বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাস নয়, বরং ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসের ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ। উপন্যাসটিতে বীরত্ব, প্রেম, যুদ্ধ, প্রতিশোধ, ট্র্যাজেডি ও ঐতিহাসিক আবহের যে সংমিশ্রণ ঘটেছে, তা বাংলা সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকর্ম পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসের ধারা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই উপন্যাসের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ জন্মায় এবং এটি পরবর্তী সাহিত্যিকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। সাহিত্যিক ও গবেষকরা একে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার
“দুর্গেশনন্দিনী” বাংলা উপন্যাসের এক মাইলফলক, যা শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, ঐতিহাসিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইতিহাসের রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়ে বাংলা উপন্যাসের গতিপথকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। তার সাহসী ভাষা, শক্তিশালী কাহিনি ও মননশীল রচনারীতি বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
লেখক পরিচিতি (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক। তিনি আধুনিক বাংলা উপন্যাসের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে “দুর্গেশনন্দিনী” (১৮৬৫) বাংলা ভাষায় প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। “আনন্দমঠ” (১৮৮২) উপন্যাসের “বন্দে মাতরম” গানটি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে “কপালকুণ্ডলা” (১৮৬৬), “মৃণালিনী” (১৮৬৯), “চন্দ্রশেখর” (১৮৭৭) ও “রাজসিংহ” (১৮৮১)।
তিনি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ধর্ম ও দর্শন নিয়েও লিখেছেন। তার “কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থ হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যের গভীর বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। বাংলা ভাষাকে সহজ ও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।
১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন। তার সাহিত্যকর্ম ভারতীয় জাতিসত্তা গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছে এবং আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে।
1 thought on “দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের সমালোচনা-1865”